: সাইফুল শাহীন :
চীন দেশের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর বাংলাদেশ সফর কেমন হলো? কিম্বা এই সফর দুদেশের সম্পর্ক কতটা এগিয়ে নিয়ে গেলো? সরকার ঘোষিত চুক্তিগুলো কতটা বাস্তবিক? এমন প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে এখন দেশের ফুটপাতের চা এর কাপ থেকে বোকা বাক্সের রম্যালোচনাকে ঘিরে।
তবে যে যাই বলুক, জিনপিং – হাসিনা বৈঠকে দুদেশের সম্পর্ক যে নতুন একটি পথ- পরিক্রমায় আবর্ত হয়েছে সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। চীনা প্রেসিডেন্টের কথাতেই তা সুষ্পষ্ট; যাকে তিনি নতুন এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনায় সঙ্গায়িত করেছেনও বটে।
সেই সাথে – বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ ঘনিষ্ট সম্পর্ককে এবার দু দেশের মধ্যকার কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্কে উন্নীত করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন জিনপিং !
এদিকে দুজনের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে দুদেশের মধ্যকার নানা ধরণের ২৬ টি চুক্তির সমঝোতা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রধান, এছাড়াও এই সফরে চীনা প্রেসিডেন্টের বিপুল পরিমান বিনিয়োগ নিয়ে আসাটাকে একটা রেকর্ড মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও চুক্তির ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবেই নিতে হবে হাসিনা সরকারকে …
কিন্তু চীন আসলে বাংলাদেশের কোন কোন খাতে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে? এর মধ্যে কয়টি প্রকল্প আসলেই এপর্যন্ত চূড়ান্ত হয়েছে? এসব প্রশ্নের ধোয়াটে ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের আপামর জনতা। কারণ আধুনিক দেশের ডিজিটাল সময়ে দেশের মানুষের মধ্যে স্ব-চেতনাবোধ দিনদিন এতটাই প্রখর হচ্ছে যে, নিজের খেয়ে বনের মোষ তারানোতে অতি উৎসাহী সবাই, কিন্তু মূল্যবান ভোট দিয়ে দেশ পরিচালনার দায়ীত্বে বসানো ক্ষমতাবানদের শোষণ-পীড়নের যাতাকলে দলিত জনতার, মানবিক মূল্যহীন রাষ্ট্রের দূর্ণীতিগ্রস্থ অস্থির বাজারের আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খোঁজ নেবার সৎ সাহস কি আছে ? একটি গনতান্ত্রিক দেশের আম জনতাদের সরকারী কাজ কর্মের হিসাব নিকাশ চাওয়ার অধিকার কি আছে?
তবে আর উলুবনে মুক্তা না ছড়িয়ে , ওসব রাজকীয় রাজনীতিক মারপ্যাচে নিজেকে না জড়িয়ে বরং চলুন অপরিবর্তিত ইতিহাসের কিছু অজানা পথে হেঁটে আসি,সেখানে হয়তো নানা অজানা জিজ্ঞাসার কিছু উত্তর হঠাৎ করে মিলেও যেতে পাড়ে!
ষাটের দশকের কথা, সে সময় বিজ্ঞান গবেষণায় উন্নতিকল্পে কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারবে, সমাজতন্ত্র নাকি ধনতন্ত্র ? এমন প্রশ্নের বিতর্কে শুরু হয় রুশ-মার্কিন শীতল যুদ্ধ| একদিকে যখন সেই বিতর্কে সরগরম পুরো বিশ্ব, অন্যদিকে তখন আমেরিকাকে বিজ্ঞন গবেষণায় পেছনে ফেলে কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক মহাশূন্যে প্রেরণ করিয়া কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটি বিশ্ববাসীকে তাক লাগাইয়া দিয়াছিল!
এতে প্রমান হয়েছিল যে, গবেষণায় সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকাকে পিছনে ফেলিয়া দিয়াছে। অর্থাৎ, ধনতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্রই ওই পথে অগ্রগতির সহায়ক।
এমন উদাহরন সামনে এনে এটা বলাই যায় যে, মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণায় নানা ক্ষেত্রে চিন ভারত অপেক্ষা অগ্রবর্তী। মহাকর্ষ তরঙ্গ গবেষণায় সাফল্য বা অসাফল্য আরও এক বার প্রমাণ করিবে প্রতিযোগিতায় কে অগ্রবর্তী, ভারত না চিন?
চলুন আবার ফিরে যাই শুরুর আলোচনায়, বাংলাদেশে সফরের আগে এক বিবৃতিতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে চীন। গত ৪১ বছর ধরেই আমাদের সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে আরও ভালো হচ্ছে।এছাড়াও উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশ এবং চীনের মনোভাব একই রকম। বাংলাদেশ যেমন সোনার বাংলা গড়তে চায়, তেমনি চীনের স্বপ্ন চির শান্তির দেশ হিসেবে নিজেদেরকে পুন:প্রতিষ্ঠিত করা।
জিনপিং এও বলেন, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য বাংলাদেশি নেতার সঙ্গে আলোচনার জন্য আমি মুখিয়ে আছি। আমাদের পারস্পরিক স্বার্থ আর সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়র সূচনা করতে চাই’। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বহুল প্রতীক্ষিত সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। অতীতের দশকগুলোতে এ দুই দেশের সম্পর্ক পরিপক্কতা লাভ করেছে।
প্রেসিডেন্ট জিনপিং বর্তমানে চীনের শুধু প্রেসিডেন্টই নন, তিনি সেই দেশের অবিসংবাদিত নেতাও। তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি এবং সেই দেশের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের সভাপতি। ৬৩ বছরের জিনপিং ২০১২ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে শি জিনপিংয়ের প্রথম মেয়াদ ২০১৭ সালে শেষ হবে। অতএব, সেখানকার নিয়মানুযায়ী ২০২২ সাল পর্যন্ত তাঁর চীনের প্রেসিডেন্ট ও অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে অবস্থানের আশা করাই যায়।’
সুতরাং ধরে নেয়া যেতে পারে যে, প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সেগুলো বাস্তবায়নে সক্রিয় থাকবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সই করা চুক্তি, সমঝোতা স্মারক সই এবং বিভিন্ন প্রকল্প উদ্বোধনের পাশাপাশি এই সক্রিয়তার অন্যতম একটি লক্ষণ হলো ২০১৭ সালকে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী ও বিনিময়ের বছর হিসেবে ঘোষণা।
এদিকে বাংলাদেশের সাথে যে চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে সেগুলো চীনের ‘এক বেল্ট, এক রোড’ পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বলা যেতে পারে এগুলো ‘এক বেল্ট, এক রোড’ পরিকল্পনার অংশ। বাংলাদেশও এই পরিকল্পনাকে সমর্থন জানিয়েছে।
এছাড়া এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠাও চীনের পরিকল্পনার অংশ। সে হিসেবে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের নেতৃত্বে-কর্তৃত্বে পরিচালিত বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চীন এগিয়ে যাওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে।
লেখক, সাংবাদিক